ইসলাম ডেস্ক: বিবাহ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে তার জীবন ধারণের জন্য কিছু চাহিদা দিয়েছেন এবং চাহিদা মিটানোর পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন। মানব জীবনে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ন্যায় জৈবিক চাহিদাও গুরুত্বপূর্ণ। এই চাহিদা পূরণের জন্য ইসলাম বিবাহের বিধান দিয়েছে। একজন ছেলে ও একজন মেয়ের একসঙ্গে থাকার সামাজিক বৈধতার অপর নাম বিয়ে। একেক ধর্মে একেকভাবে বিয়ের নিয়ম প্রচলিত রয়েছে।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘তোমরা তাদের অভিবাবকদের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করো, যথাযথভাবে তাদের মোহর প্রদান করো, যেন তারা বিয়ের দুর্গে সুরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে এবং অবাধ যৌনচর্চা ও গোপন বন্ধুত্বে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।’ (সূরা নিসা-২৫)
বিয়ে সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, দুনিয়ার সব কিছুই (ক্ষণস্থায়ী) সম্পদ, তবে সব সম্পদের তুলনায় সতী-সাধ্বী রমণীই হলো সর্বোত্তম সম্পদ। (মুসলিম)
বিবাহের শর্তাবলী
বিবাহের শর্ত হলো চারটি।
১। পরস্পর বিবাহ বৈধ এমন পাত্র-পাত্রী নির্বাচন,
২। উভয়ের সম্মতি,
৩। মেয়ের ওয়ালী (অভিভাবক) থাকা এবং
৪। দু’জন ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষী থাকা।
বিবাহের রুকন
১. ইজাব বা প্রস্তাব করা,
২. কবুল বা গ্রহণ করা।
বিবাহের এ দু’টি রুকন হলো বিয়ের মূল উপকরণ।
উক্ত শর্তাবলীর কোন একটি পূরণ না হলে বিবাহ শুদ্ধ হবে না। উল্লেখ্য, যে মেয়ের ওলী বা অভিভাবক নেই, তার ওলী হবেন সরকার।
‘তোমাদের মাঝে যার কোন (পুত্র বা কন্যা) সন্তান জন্ম হয়, সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম আদব কায়দা শিক্ষা দেয়। যখন সে বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) তখন যেন তার বিয়ে দেয়। যদি সে বালেগ হয় এবং তার বিয়ে না দেয়; তাহলে সে কোন পাপ করলে উক্ত পাপের দায়ভার তার পিতার উপর বর্তাবে।’ – (বায়হাকি, মিশকাত: হাদীস নং- ৩১৩৮)
মুসলিম বিয়ের নিয়মাবলী
ইসলামের প্রতিটি কাজের সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। বিবাহ তার ব্যতিক্রম নয়। বিবাহের সংক্ষিপ্ত নিয়ম হলো- উপযুক্ত বয়সের ছেলে-মেয়েকে তাদের অভিভাবক বিবাহের প্রস্তাব দিবেন। সম্ভব হলে ছেলে-মেয়ে একে অপরকে দেখে তাদের অভিমত জানাবে। উভয়ে একমত হ’লে নির্দিষ্ট দিনে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে মেয়ের অভিভাবক নির্দিষ্ট মহরের বিনিময়ে ছেলের সাথে মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব দিবেন। ছেলে কবুল বলে গ্রহণ করবে। যাকে আরবীতে ঈজাব ও কবুল বলা হয়।
ইসলামী বিয়ে হল বিবাহযোগ্য দু’জন নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কের বৈধ আইনি চুক্তি ও তার স্বীকারোক্তি। মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর ধার্য করা হয় ছেলের আর্থিক সামর্থ্য ও অবস্থান অনুযায়ী।
বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ন্যায়পরায়ণ ঈমানদার দু’জন সাক্ষী থাকবে। সাক্ষীগণ মহরের পরিমাণ ও বরের স্বীকারোক্তি নিজ কানে শুনবেন। আল্লাহ বলেন, ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺑَﻠَﻐْﻦَ ﺃَﺟَﻠَﻬُﻦَّ ﻓَﺄَﻣْﺴِﻜُﻮْﻫُﻦَّ ﺑِﻤَﻌْﺮُﻭْﻑٍ ﺃَﻭْ ﻓَﺎﺭِﻗُﻮْﻫُﻦَّ ﺑِﻤَﻌْﺮُﻭْﻑٍ ﻭَﺃَﺷْﻬِﺪُﻭْﺍ ﺫَﻭَﻱْ ﻋَﺪْﻝٍ ﻣِّﻨﻜُﻢْ – অর্থ- ‘যখন তারা ইদ্দতে পৌঁছে যায়, তখন যথাবিধি তাদেরকে রেখে দিবে, নতুবা তাদেরকে যথাবিধি বিচ্ছিন্ন করে দিবে এবং তোমাদের মধ্য হতে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোককে সাক্ষী রাখবে।’ (তালাক্ব ৬৫/২)
সাক্ষীগণ পুরুষই হ’তে হবে। একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা কিংবা চারজন মহিলা হলেও চলবে না। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ﻻَ ﻧِﻜَﺎﺡَ ﺇِﻻَّ ﺑِﻮَﻟِﻰٍّ ﻭَﺷَﺎﻫِﺪَﻯْ ﻋَﺪْﻝٍ অর্থ- ‘বিবাহ সংগঠিত হবে না অভিভাবক ও দু’জন সাক্ষী ব্যতীত।’
বিয়ের সময় একজন উকিল থাকেন। তিনি কনে পক্ষ অথবা ছেলে পক্ষের হতে পারেন। তবে সাধারণত কনে পক্ষ থেকেই উকিল থাকে। উকিল প্রথমে কনেকে জিজ্ঞাসা করেন বিয়েতে রাজি আছে কি না? কনে রাজি থাকলে বরকে তা বলা হয়। এরপর দোয়া কালাম করে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়।
ইসলামী বিবাহে বর, কনে এবং কনের অভিভাবকের (ওয়ালী) সম্মতির (কবুল) প্রয়োজন হয়। বৈবাহিক চুক্তিটি অবশ্যই কনের অভিভাবক (ওয়ালী) এবং বরের দ্বারা সম্পাদিত হতে হবে। বর এবং কনের দ্বারা নয়। ওয়ালী সাধারণত কনের পুরুষ অভিভাবক হন। প্রাথমিকভাবে কনের বাবাকেই ওয়ালী হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য বাবা ছাড়াও ওয়ালী হতে পারে। মুসলিম বিয়েতে ওয়ালীকেও অবশ্যই একজন মুসলিম হতে হবে। বৈবাহিক চুক্তির সময় চাইলে কনেও সে স্থানে উপস্থিত থাকতে পারেন, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। বিয়ের পর ঘোষণা করে বা অন্য যে কোন পন্থায় সামাজিকভাবে তা জানিয়ে দিতে হবে, যাকে ‘এলান করা’ বলা হয়।
ইসলামী পদ্ধতিতে বিয়ের জন্য নিম্নোক্ত ৮টি কাজ আবশ্যক
১। পাত্র-পাত্রীর সম্মতি,
২। অভিভাবকের সম্মতি,
৩। পাত্র-পাত্রীর মাঝে সমতা,
৪। নিয়ত শুদ্ধ করা,
৫। পাত্র-পাত্রী দর্শন,
৬। বিবাহের প্রস্তাব,
৭। সাক্ষী এবং
৮। বিয়ে পড়ানো।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাক স্বরূপ আর তোমরাও তাদের জন্য পোশাক স্বরূপ।’ (সূরা বাকারাহ-১৮৭)
আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, ‘যদি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা কোন মুসলিম যুবকের দ্বীন এবং ব্যবহার (চরিত্র) তোমাকে সন্তুষ্ট করে তাহলে তোমার অধীনস্থ নারীর সাথে তার বিয়ে দাও। এর অনথ্যায় হলে পৃথিবীতে ফিতনা ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে।’ – (আল-তিরমিযি, মুসলিম পণ্ডিত নাসিরুদ্দিন আলবানি হাদিসটিকে হাসান বলে সাব্যস্ত করেছেন।)
ইসলাম ধর্ম মতে, কনে তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী বিয়েতে মত বা অমত দিতে পারে। একটি আনুষ্ঠানিক এবং দৃঢ় বৈবাহিক চুক্তিকে ইসলামে বিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বর ও কনের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের সীমারেখা নির্ধারণ করে। ইসলামী বিয়ে হল সুন্নাহ বা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আদর্শ। তাছাড়া ইসলামে বিয়ে করার জন্য অত্যন্ত জোরালোভাবে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিয়ে ইসলামী বিবাহের মৌলিক বিধিবিধান অনুযায়ী সম্পন্ন করতে হয়।
ইসলামে বিয়ের মাধ্যমে যেমন সম্পর্ক গড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, তেমনি সন্ন্যাসজীবন এবং কৌমার্যেরও কঠোর বিরোধিতা করা হয়েছে। ইসলামে তালাক অপছন্দনীয় হলেও এর অনুমতি আছে এবং তা যে কোন পক্ষ হতে দেওয়া যেতে পারে। তবে দেশ অনুযায়ী বিবাহ ও তালাক বিষয়ক আইনের কিছু ভিন্নতা আছে যা সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতি ও নৈতিকতার দ্বারা প্রণীত হয়।
ইসলাম আগমনের পর রাসূল (সা.) প্রচলিত বৈবাহিক রীতির পুনর্গঠন করেন। তিনি চুক্তি ভিত্তিক বিবাহ এবং যৌতুকের বিবাহের পুনর্গঠন করে কনেকে মত প্রকাশের অধিকার দেন এবং যৌতুক বা পণ মেয়েপক্ষ হতে ছেলেকে দেয়ার পরিবর্তে ছেলেপক্ষ হতে মেয়েকে পণ দেয়ার বিধান চালু করেন; যাকে দেনমোহর নামে অবহিত করা হয়। এর পাশাপাশি সম্পত্তি বিবাহ ও বন্দীকরণ বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করেন। কুরআনের অনেক আদেশ নিষেধ সম্পর্কিত আয়াত তখন এ বিষয়ে নাজিল হয়।
‘তিনি তোমাদের (স্বামী-স্ত্রী) একে অন্যের সাথী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন ‘ (সূরা রুম-২১)
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোন বান্দা বিবাহ করলো তখন যে তার অর্ধেক ঈমান পূর্ণ করল। আর বাকী অর্ধেক এর জন্য সে যেন তাকওয়া অবলম্বন করে।’ (বায়হাকী)
অভিভাবকের অনুমতি না নিয়ে বা পালিয়ে বিয়ে করা জায়েয আছে কি?
ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া বা পাপ হতে মুক্ত থাকার জন্য অভিভাবক ছাড়া বা পালিয়ে বিয়ে করা জায়েয। তবে এটা না করাই ভালো। সে জন্য এরকম পরিস্থিতির যেনো সৃষ্টি না হয়, সেভাবেই তৈরি হতে হবে। বাধ্য হয়ে যদি করতেই হয়, তবে খেয়াল রাখতে হবে ইসলামী বিয়র মূল উপকরণ ওয়ালী, ইজাব, কবুল, স্বাক্ষী, দেনমোহর যেনো বাদ না যায়।
আকদ করতে চাইলে প্রথমে কি কাজ করতে হবে?
আকদ করতে চাইলে পূর্বে মহর ধার্য না হয়ে থাকলে প্রথমে মহর ধার্য করবে। (সামর্থ অনুযায়ী) কম মহর ধার্য করার মধ্যেই বরকত নিহিত।
খুতবা পাঠ করার পর বিয়ে কিভাবে পড়াবে?
খুতবা পাঠ করার পর দুজন স্বাক্ষীর সম্মুখে তাদেরকে শুনিয়ে উকিল (বা পাত্রী) পাত্রকে বা তার নিযুক্ত প্রতিনিধিকে পাত্রীর পরিচয় প্রদান পূর্বক বিয়ের প্রস্তাব পেশ করবে এবং পাত্র বা তার প্রতিনিধি তার পক্ষ হয়ে আমি কবুল করলাম বা আমি গ্রহণ করলাম বা এরকম কোন বাক্য বলে সে প্রস্তাব গ্রহণ করবে। এতেই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যায়।
বিয়ের জন্য কতজন স্বাক্ষীর প্রয়োজন?
ইসলামী রীতিতে বিয়ের জন্য দুইজন স্বাধীন ও ন্যায়পরায়ণ স্বাক্ষীর প্রয়োজন।